শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫ ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
চাষাবাদে আগ্রহ-অনাগ্রহ প্রসঙ্গে
Published : Wednesday, 23 November, 2016 at 6:00 AM, Count : 1277

নাছিউর রহমান : এক তামাক চাষির কথা জানলাম পত্রিকান্তরে মনতাজ আলী নামের এই চাষি প্রথমে ছিলেন আলু চাষি সেখান থেকে তিনি হলেন তামাক চাষি আলু আবাদ করে খালি লোকসান দুই টাকা কেজি আলু তাও বিক্রি নেই নগদ টাকার জন্যে হামরা তামাক চাষ করচি আর তামাক চাষ করলে হামাক তেল নাগায় কম্পানির লোক বাড়ি থাকি তামাক কিনি নিয়া যায় রংপুর অঞ্চলের মমতাজ আলীর এই উক্তি থেকেই বুঝা যায়- আলু চাষ রেখে বিষাক্ত ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও কেন তামাক চাষে ঝুঁকলেন প্রায় ১৫০ শতক জমিতে মনতাজ আলী তামাক চাষ করেছেন শুধু মনতাজ আলী-ই নয়, তামাক চাষপ্রবণ এলাকার প্রতি চাষিরই অবস্থা একই রকম

ফলে তামাকের ভয়াবহতা জেনেও তামাক আবাদ থেকে মুখ ফেরানো যাচ্ছে না অন্য ফসলে লোকসান হওয়ায় কৃষকরা ঝুঁকছেন তামাক চাষে দিনে দিনে বাড়ছে তামাক আবাদের জমি কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুত্সাহিত করতে মাঝে মধ্যে সভা, সেমিনার হয় এছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগেও এ ধরনের কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না জানা যায়, বিভিন্ন কোম্পানির লোকজন কৃষকদের আগাম টাকা ও কীটনাশক দেয় যাতে আরও বেশি জমিতে তামাক আবাদ করেন কৃষকরা

টাঙ্গাইলের ধলেশ্বরী নদীঘেঁষা নাগরপুর, দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল সদর ও কালিহাতী এলাকা সম্পর্কে জানতে পারলাম- এখানকার জমিতে মিষ্টি আলু, কাউন, চিনা ইত্যাদি ফসল চাষ করলেও ফলন তেমন ভালো হয় না অথচ তামাক চাষ করলে দ্বিগুণ লাভবান হওয়া যায় যদিও তামাকের জমিতে অন্য কোনো ফসল হয় না, তাতে কী? তামাক চাষে প্রায় দুফসলের সমান লাভবান হচ্ছেন চাষিরা

এছাড়া তামাকজাত কোম্পানিগুলো তাদের চাষের জন্য অগ্রিম টাকা দেয় ও ন্যায্যমূল্যে বিক্রির নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে

স্থানীয় সংশ্লিষ্টদের মতে, তামাক চাষ হ্রাসে কৃষকদের সচেতনতা বাড়াতে কাউন্সিলিং করা হলেও যেসব জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে সেসব জমিতে অন্য ফসল স্বল্প লাভজনক তাই কৃষকদের বলেও তামাক চাষ বন্ধ করা যাচ্ছে না ধলেশ্বরীর পাড় ঘেঁষে যেভাবে দিন দিন তামাকের চাষ বাড়ছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলি জমি-নদীর জলজ প্রাণী এখনই যদি বিষাক্ত তামাক চাষ বন্ধ করা না যায় তবে ভবিষ্যতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ অর্থাত্ প্রায় ৪ কোটি ১৩ লাখ (২০০৯) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক সেবন করেন, যার মধ্যে ২৩ শতাংশ (২ কোটি ১৯ লাখ) ধূমপানের মাধ্যমে তামাক ব্যবহার করেন এবং ২৭.২ শতাংশ (২ কোটি ৫৯ লাখ) ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহার করেন বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭ শতাংশ (ণেঞঝ, ২০১৩) কিশোর-কিশোরী তামাকপণ্য ব্যবহার করে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ (ওঐগঊ, ২০১৩) মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করে তামাক খাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিত্সায় সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয় এভাবে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়

গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেট বা অন্যান্য তামাকের ভয়াবহতায় বিশ্বের ৭৭টি দেশে তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে ছবিসহ স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা সংযোজন করেছে সরকার ভারতে সিগারেটের প্যাকেটের মোড়কের সামনে এবং পেছনে ৮৫ শতাংশ, নেপালে ৯০ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৮৫ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় প্যাকেটের সামনে ৭৫ শতাংশ এবং পেছনে ৯০ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় সামনে পেছনে ৮০ শতাংশ এমনকি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ২৮টি দেশও সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে ৬৫ শতাংশ স্থানজুড়ে ছবিসহ স্বাস্থ্যবার্তা জুড়ে দিয়েছে সম্প্রতি এক রিপোর্ট থেকে জানলাম তামাক চাষ জীববৈচিত্র্যের জন্যও হুমকি

এতে উল্লেখ করা হয়- ক্রমেই ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে এক সময়ের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ধ্বংসলীলায় যুক্ত নানাবিধ প্রক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসেবে অবির্ভূত হয়েছে তামাক চাষ আমরা জানি তামাক কোনো খাদ্য ফসল নয়, কৃষি ফসলের পর্যায়েও পড়ে না এমনকি প্রয়োজনীয় কোনো শিল্পের কাঁচামালও নয় এর চাষ করা হয়ে থাকে শুধু পাতা উত্পাদনের জন্য

নিকোটিন নামক বিশেষ উপাদান থাকে বলেই তা প্রকৃতির অন্যান্য পাতা হতে ভিন্ন এবং বিশেষ মূল্য ধারণ করে থাকে, যা থেকে প্রধানত তৈরি হয় বিভিন্ন মান ও ব্র্যান্ডের সিগারেট এবং বিড়ি এছাড়াও জর্দা ও গুল তৈরির অন্যতম প্রধান উপকরণ এই তামাক পাতা বিংশ শতাব্দীতে তামাকজাত পণ্য সেবনের কারণে পৃথিবীতে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১০০ মিলিয়ন, যা কি-না দুটি বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের মোট সংখ্যার চেয়েও অধিক

বিভিন্ন গবেষণা মতে তামাকজাত পণ্য সেবনের দরুণ চলতি শতাব্দীতে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াতে পারে ১০০০ মিলিয়ন বা ১শ কোটিতে উপরি উক্ত হিসেবটি শুধু তামাকজাত পণ্য সেবনজনিত প্রভাব থেকে এছাড়াও তামাক চাষের ক্ষতি আরও বিস্তৃত ও ভয়াবহ তামাক উত্পাদন বাংলাদেশে নতুন নয় বরং অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে তখন বাণিজ্যিক উদ্দেশে উত্পাদন হতো না, তা হতো কেবল পানের সঙ্গে খাওয়া এবং হুকা বা বিড়ির জন্য ভয়াবহতার দিকটি বিবেচনায় বিশ্বের ধনী দেশগুলোয় তামাক চাষ আজ প্রায় নিষিদ্ধ চাহিদার জোগান নিশ্চিত করতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ তামাক চাষের ক্ষেত্র হিসেবে তারা বেছে নেয় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে এই পরিস্থিতিতে ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো (বিএটি) কোম্পানি বাংলাদেশের (তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তান) রংপুর এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে তামাক চাষ শুরু করে সফল পরীক্ষার পর ১৯৭১ এর পর বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে এর চাষ ব্যাপকভাবে শুরু হয় দুই থেকে তিনটি জাতের তামাক যেমন-ফ্লু কিউড ভার্জিনিয়া, মতিহারী ও বার্লি সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে ফ্লু কিউড ভার্জিনিয়া জাতের তামাক এখানে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে, যা কোম্পানিগুলোকে আগে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো বর্তমানে আর আমদানির প্রয়োজন হয় না

বৃহত্তর রংপুরের প্রায় সব জেলার পাশাপাশি তামাক চাষ ছড়িয়ে পড়েছে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, নাটোরের চলনবিল এলাকা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার এমনকি পার্বত্য জেলাগুলোসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কুষ্টিয়া এলাকায় জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হওয়া ও জ্বালানি কাঠের অপর্যাপ্ততার কারণে পার্বত্য বান্দরবানে সর্বপ্রথম তামাক চাষ বিস্তৃত হয় ১৯৯৮ সালে

২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সারাদেশে প্রায় ১,০৮,০০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে অথচ আগের অর্থবছরে (২০১২-১৩) এর পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার হেক্টর অর্থাত্, এক বছরেই বেড়ে যায় ৩৮ হাজার হেক্টর বাংলাদেশ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর মতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে তামাক রফতানি করে জাতীয় আয়ের খাতায় যুক্ত হয়েছিল ৫ কোটি মার্কিন ডলার অথচ, তার আগের অর্থবছরে একই পরিমাণ জমিতে উত্পাদিত কৃষি পণ্য রফতানি করে আয় হয়েছিল ৯ কোটি ডলার শুতরাং, রফতানি পণ্য হিসেবে তামাককে বোধ হয় অধিক অর্থকরী বলার সুযোগ থাকে না

বান্দরবান ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য পাহাড়গুলোতে পুরনো বৃক্ষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে বিশেষ করে বনজ, ফলদ ও ঔষধি গাছ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে উল্লেখ্য, অপরিকল্পিত জুম চাষের কারণে গভীর পার্বত্য অঞ্চল ইতোমধ্যেই প্রায় বৃক্ষশূন্য ও বিরান হয়ে গেছে যার পেছনে স্থানীয়দের অসচেতনতা দায়ী এছাড়াও দায়ী রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই পরিস্থিতিতে অবশ্য বিএটি নিজেদেরকে হিতাকাঙ্ক্ষী ও পরিবেশবান্ধব প্রমাণ করতে গিয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একাশিয়া, ইউকেলিপ্টাসের মতো বৃক্ষ রোপণ করছে যা এখানকার পরিবেশ অনুপযোগী প্রকারান্তরে এই হাস্যকর উদ্যোগটি তাদের নিজেদের সুবিধার জন্যই গৃহীত, যা পার্বত্য এলাকার স্বতন্ত্র প্রকৃতির জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ

তামাক চাষাবাদের এলাকায় বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবেন, তারও উপায় নেই হাওয়ায় ভাসে তামাটে গন্ধ হঠাত্ করে গ্রামে আসা অনেকেই তামাকের উত্কট গন্ধে নাকে রুমাল চেপে পথ চলছেন ঘরের আঙিনায় পা ফেলবেন, ফুসরত নেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তামাক পাতা মাঠ-ঘাট কিংবা রাস্তার ধারে বাঁশের বেড়া, কোথাও খালি নেই রোদে শুকানো হচ্ছে তামাক বাড়ি বাড়ি শুকনো তামাকের স্তূপ করে মাচা ভর্তি করা হচ্ছে আর এসব কাজে ব্যস্ত নারী পুরুষ, এমনকি শিশুরাও রংপুর অঞ্চলে তামাক পাতায় তৈরি হচ্ছে বিড়ি-সিগারেট-গুলসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য প্রাণঘাতক নিকোটিন আছে জেনেও দেদার চলছে তামাক চাষ!

গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁচা তামাক পাতা থেকে গ্রিন টোব্যাকো সিকনেস গোত্রের নানা অসুখ দেখা দিচ্ছে দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, নানা ধরনের চর্মরোগ, অনিয়মিত হূদস্পন্দন ও শ্বাসকষ্ট যার মধ্যে অন্যতম এখানেই থেমে নেই, অনেকেই মরণঘাতী ক্যানসারে পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে অথচ, পার্বত্য এলাকায় তামাক চাষপূর্ব পরিস্থিতিতে এসব রোগ ছিল না বললেই চলে মৌসুমের আগেই কোম্পানি আবার যখন কৃষককে আগাম অর্থ দিতে আসে তখন তারা টাকা নেয় বটে, তবে তা ব্যয় হয়ে যায় খাদ্যপণ্য ক্রয় এবং চিকিত্সার পেছনে যার ফলে পরের মৌসুমে তামাক চাষের জন্য কোম্পানির কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়ে সেই সুযোগকে কাজে লাগায় ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী বেসরকারি সংস্থাগুলো পরিণতিতে কৃষক বাঁধা পড়ে এক ভয়াবহ ঋণের জালে

তামাক চাষের এই খড়গকৃপাণে আমাদের সংবেদনশীল অস্তিত্ব কি নির্বিকার থাকবে? তিলে তিলে বিনাশ হতে দেখবে মায়ের মতো অকৃপণ প্রকৃতিকে? আমাদের করার কি কিছুই নেই? নাকি জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের দায় আমাদের সবার, এই কথাটি মেনে নিয়ে বসে থাকব! কেন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে সেই আলু চাষিকে তামাক চাষ ছেড়ে আবার আলু চাষে ফিরিয়ে আনা যায় না? পারতে হবে আলু চাষি মনতাজ আলীদের খবর রাখতে হবে যাতে তারা চাষাবাদের ন্যায্যমূল্য পেতে পারে, জীবন জীবিকায় স্বাচ্ছন্দ্যময়তা ধরে রাখতে পারে তবেই তারা আর লোকাসনের তাড়া খেয়ে প্রকৃত চাষাবাদ রেখে তামাক চাষের দিকে ধাবিত হবে না আর এভাবেই রোধ হতে পারে তামাক চাষের আগ্রাসন



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : news.bartoman@gmail.com, bartamandhaka@gmail.com