শিরোনাম: |
রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হোক নিরাপদ
|
অনেকের মনে কিছু সন্দেহ ও উদ্বেগের সূচনা হয়েছে এই স্মারকের অস্পষ্টতা বা ব্যবস্থাপনা নিয়ে। বলা যায় দীর্ঘ মেয়াদি সমস্যার সমাধান কবে হবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হোক, কিন্তু এই ব্যবস্থা তার কতটা সন্ধান দিতে পারবে, এ প্রশ্ন অনেকের। হিউমান রাইটস এর এক কর্মকর্তার অভিমত হচ্ছে এ স্মারক চুক্তি হচ্ছে মিয়ানামারের স্ট্যান্ডবাজি যা বিশ্ব পরিমণ্ডলে তাদের অবস্থানকে সমালোচনা থেকে সাময়িক মুক্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রধানত কয়েকটি কারণে এমন একটি সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে- প্রথমত কোনো তৃতীয় পক্ষ বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থাকে বা জাতিসংঘকে চুক্তি চূড়ান্তকরণের প্রাক্কালে সংযুক্ত করা হয়নি। তবে সমস্যার সমাধান যদি দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে হয়, তাই হয় দীর্ঘস্থায়ী। দ্বিতীয়ত যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ কবে হবে তার কোনো সময়সীমা নির্দ্ধারণ করা হয়নি। তবে সরকার বলছে দু’মাসের মধ্যেই শুরু হবে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা। তৃতীয়ত, আগুনে ভস্ম হয়ে যাওয়া রেহিঙ্গাদের গ্রামগুলোতে তারা ফিরবে কেমন করে? অন্য কোথাও প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করলে পরবর্তীতে তাদের কোথায় কি জাতীয় আবাসন হবে? চতুর্থত, স্বাক্ষরিত স্মারকে যে ব্যবস্থাপনার কথা ভাবা হয়েছে তাতে ১৯৯২ সালে দুইদেশের মধ্যে সংগঠিত চুক্তির কথা বলা হয়েছে যাতে মিয়ানমানের নাগরিকত্ব প্রমাণ প্রর্দশনকারীদের ফেরত নেযার কথা বলা হয়েছে, এখনও তাই বহাল থাকল। কিন্তু ১৯৮২ সালের পর থেকে রেহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকার বঞ্চিত করে আসছে। পঞ্চমত, এই ব্যবস্থায় শুধুমাত্র ২৫ আগস্ট ২০১৭ এরপর থেকে আগত ৬ লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের কথা বলা হয়েছে, এখানে ১৯৯২ সাল থেকে বিতাড়িত এবং বাংলাদেশে শরণার্থী হওয়া আরও ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের কি হবে, বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এসব ছাড়াও মিয়ামানের সেনাপ্রধান গণচীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং সেখানে রাখাইন ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যা অনেক নতুন ভাবনার জন্ম দিয়েছে। মিয়ানমারে বর্তমানে কারেণ বিদ্রোহীসহ কয়েকটি বিদ্রোহীগোষ্ঠী সক্রিয় আছে। এছাড়া, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশান আর্মি যুদ্ধ বিরতি করতে পারে কিন্তু বিলীন হয়েছে বা তাদের কর্মসূচি থেকে সরে পড়েছে বলে মনে হয় না। বহুমুখী ভাবনার মাঝেও বলা যায় যে কোনো চুক্তির শুরুতে অনেক কথা থাকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সমাধান মিলে এবং পরিবেশ ও পরিস্থিতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক সমাধানের সন্ধান দেয়। রোহিঙ্গারা নিরাপদে রাখাইন রাজ্যে ফিরতে পারবে এমনটি আশা ও ভরসাই হচ্ছে এখনকার প্রাপ্তি। ভবিষ্যত্ বলবে দু’মাসের মধ্যেই তাদের ফেরত যাত্রা শুরু হবে কিনা। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যার্বতন নিয়ে আমাদের অনেক আনন্দ, অনেক ভরসা, কিন্তু কেন? কারণ হচ্ছে ১৯৭২ জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বাধীন বাংলাদেশের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান কলকাতার সল্ট লেইকের বিশাল শরণার্থী শিবিরে গিয়ে শরণার্থীদের আহবান জানালেন, ‘চলুন এবার আমরা দেশে ফিরে যাই, নিজের মাতৃভূমিতে, স্বাধীন দেশের মুক্ত বাতাসে শান্তির নিঃশ্বাস নিব। শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা বিধৌত সোনার দেশ, সবুজ দিগন্ত প্রসারিত শস্য-শ্যামলা এ বাংলা এখন আমাদের সকলের, হানাদারমুক্ত স্বদেশ এখন স্বাধীন। চলুন দেশে ফিরে যাই, এখন সবাই মিলে সোনার বাংলাকে সাম্য ও সৌহার্দ্র্যের ভিত্তিতে নতুন করে গড়ব।’ সেদিনের উদাত্ত আহ্বান, আবেগঘন মর্মস্পর্শী বক্তৃতা, ঐক্য ও সংহতির প্রতিশ্রুতি, শরণার্থীদের হূদয়কে এমনভাবে আপ্লুত করেছিল অনেকে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। এ কান্না হচ্ছে আনন্দাশ্রু, গভীর বেদনা থেকে উঠে আসা এক অভিব্যক্তি। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম মন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসাবে। স্বদেশ ফেরার আনন্দবার্তা শরণার্থীদের জীবনে কতটা আনন্দের বন্যা বয়ে আনতে পারে তা আমি অনুভুব ও প্রত্যক্ষ করেছি হূদয় দিয়ে। তাই রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কথা শুনে আনন্দে ভরে উঠে মনপ্রাণ। আমরা চাই, জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনের যাওয়ার অধিকার ফিরে পাবে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেদনার কথা সংক্ষেপে বলতে হয়। রাখাইন সম্প্রদায়ের নিজস্ব ইতিহাস আছে, তাদের আছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সাহিত্য। রাখাইন শব্দটি পালি ভাষা থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে, নিজস্ব বংশমর্যাদা যারা রক্ষা করে। (ঙহব যিড় সধরহঃধরহং যরং ড়হি ত্ধপব). রোহিঙ্গারা ‘হানিফি’ নতুন অক্ষর সৃষ্টি করে স্বকীয়তার পরিচয় দেয়। এমন স্বাধীন চিন্তা ও চেতনা তাদের জন্য বিপদ ডেকে এনেছে বারবার। বৃহত্ জনগোষ্ঠী ও আধুনিক জীবন পদ্ধতি, ভাষা শিক্ষা ও আচরণকে তারা সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে তারা বংশানুক্রমে অনেকে শিক্ষা থেকে হয়েছে বঞ্চিত, আধুনিক জীবন পদ্ধতি, রাজনীতি ও প্রগতির কক্ষপথ থেকে তারা দূরে সরে গিয়েছে। মিয়ানমারের জন্মগত অধিবাসী হলেও তারা মনে করেছে তারা ভিন্ন জনগোষ্ঠী, যার ফলে মিয়ানমারের বৃহত্ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের ব্যবধান হয়েছে ব্যাপক। তাই ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিদের চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় ৪০ হাজার রেহিঙ্গা চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৬২ সালে বার্মায় সামরিক শাসন জারি হলে তারা কিছু’টা সুফল পায়, তবে আবার ১৯৭৮ সালে নাগামিন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের উপর চলে চরম নির্যাতন। তখনও প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা চলে আসে বাংলাদেশে। অবশেষে ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে জেনারেল নে উইন এবং চরম নির্যাতনের শিকার হয় এই জনগোষ্ঠী। তারপর আবার শুরু হয়, রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন। ১৯৯১-১৯৯২ সাল হয়ে উঠে তাদের ভয়াবহ মহাকাল, শুরু হয় বাংলাদেশে বিতাড়ন। তারই জের ধরে এবার ২৫ আগস্টে চলে ভয়াবহ নির্যাতন ও বিতাড়নের পালা। রোহিঙ্গাদের সমস্যা সহজ ব্যাপার নয় এবং রাতারাতি সমাধানের সহজপথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। অতীতে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে অনেক নাটক হয়েছে । অনেক ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি প্রতিপালনে দেখা গিয়েছে ব্যাপক আন্তরিকতার অভাব। আশা করি এমনটি এবার হবে না। কফি আনান কমিটি এবার ৮৮টি সুপারিশ দিয়েছে, যার মধ্যে আছে তাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ সরকারি চাকরি প্রদান এবং শিক্ষাদানের মাধ্যমে আধুনিক নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার সুপারিশ। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে যে এরেঞ্জমেন্ট চুক্তি হয়েছে, তাতে সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা নেই, কিন্তু বিশ্ববাসী এই বিষয়টির প্রতি নজর না দিলে মানবতাকে অবজ্ঞা করা হবে। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক মধ্যম আয়ের দেশের সরকার মানবতাকে মূল্যায়ন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবতার বাণীকে সমুজ্জ্বল করেছে, যা অনবদ্য ও ঐতিহাসিক। দেশের জনগণ ও বিভিন্ন সংগঠন ছুটে গিয়েছে সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এছাড়াও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য বস্ত্র ও চিকিত্সার ব্যবস্থাসহ বিশাল কুতুপালং এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু অবাক হই যখন দেখি অনেক গণতান্ত্রিক দেশ জাতিসঙ্গে রোহিঙ্গাদের পক্ষে ভোটদানে বিরত ছিল অথবা এমন মানবিক সমস্যাকে আলোচনার আসরে তুলে আনতে সহযোগিতা করেনি। এই নির্যাতিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আবার আরাকান রাজ্যে ফিরে গিয়ে বসতি করতে পারবে কিনা সন্দেহ। কারণ মিয়ানমার সরকারের কাছে মানবতার বাণী নিদারুণভাবে উপেক্ষিত। অহিংসার কথা যারা বলে এবং ধর্মীয়ভাবে বিশ্বাস করে, তারাই আবার হিংসা, বিদ্বেষ, নরহত্যা, মহিলা ও শিশুদেরদের প্রতি নির্যাতন এবং মানবতার চরম অবমাননা করে দ্বিধাাহীন চিত্তে। সবই করে ধর্মের লেবাসে, চরম বিধর্মী মানুষের মতো। অসহায় মানুষের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে পরিচালিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। স্বদেশে ফিরে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দিতে হবে। রাজনীতি মানুষের জন্য। মানবতার জয়গান হতে হবে আদর্শ রাজনীতির লক্ষ্য। সমগ্র দেশ ও জাতির কল্যাণ হতে হবে রাষ্ট্রনায়কদের জীবনের আদর্শ। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের শুভক্ষণে বা শুভখবরে আমরা উত্ফুল্লিত, কারণ স্বদেশে ফেরার আনন্দক্ষণকে আমাদের জীবনে আমরা উপলব্ধি করেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুভমুহূর্তে, হূদয় দিয়ে। লেখক : সাবেক সচিব। |