শিরোনাম: |
টেকসই নগর ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ
|
![]() বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের আবাসিক প্রতিনিধি চিমিয়াও ফান বলেন, ‘নগর হলো প্রবৃদ্ধির চালিকা শক্তি। কিন্তু দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ শহরের পূর্ণ কার্যক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশের নগরায়ন অবশ্যই টেকসই হতে হবে।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স এবং বিশ্বব্যাংক কর্তৃক আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে তিন শতাধিক পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদের প্রতিনিধি ছাড়াও ১৩টি দেশের জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন। দেশে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেলেও নানা কারণে নগরগুলোতে দারিদ্র্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই দশকে বাংলাদেশের নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার বেড়ে ১৫ থেকে ২১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত ৫ বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করেছে। ঢাকা শহরে ৮ শতাংশ অধিবাসী চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। আর এ শহরের ২৩ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে, যা গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্যের তুলনায় অনেক বেশি। গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য একটি বাড়ি একটি খামারের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি চালু থাকলেও নগরাঞ্চলে তা নেই। প্রখ্যাত উপন্যাসিক ড. নীহারঞ্জন রায় প্রাচীন বাংলার শহর সমন্ধে বেশ সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। তার বর্ণনা মতে, প্রাচীন যুগের বাংলার প্রতিটি শহর ছিল প্রশস্ত ও প্রচলিত মূল ও স্থলপথের ওপর বা সংযোগস্থলে অবস্থিত। সেসব প্রাচীন নগরগুলোতে রাজা, মহারাজা, সামন্ত, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক কর্মচারী প্রমুখগণ ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক। ধর্মতীর্থস্থান বা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা নগরগুলোতে গুরু, আচার্য, পুরোহিত, ছাত্র এরা ছিলেন নাগরিক। অধিকাংশ স্থানেই ব্যবসা-বাণিজ্য গুরুত্ব পেত বলে বণিকগণও ছিলেন নগরের বাসিন্দা। কর্মকার, সূত্রধর ও শংখকার প্রভৃতি পেশার অনেকেই নগরে বাস করতেন। ১৬১০ সালে বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় কেন্দ্রস্থলে ঢাকা শহর প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতিনিধি সুবেদার ইসলাম খাঁ। অতি দ্রুত এর সমৃদ্ধি এসেছিল এবং মনে করা হয় যে প্রতিষ্ঠার মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ নগরীতে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানের মতো যানজট, জলাবদ্ধতা ও ময়লা আবর্জনার উত্কট গন্ধ ও বায়ু দূষণে এত বসবাসের অনুপযোগী নগরী ছিল না ঢাকা। বাংলাদেশের অধিকাংশ নগর ও মহানগরের অবকাঠামো পর্যাপ্ত নয় এবং সেবাও নিম্ন মানের। রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পানি ও পয়োঃনিষ্কাষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, খেলার মাঠ, শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্রের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। নবগঠিত কোনো কোনো পৌরসভায় রাস্তায় দু’একটি বিজলিবাতি ছাড়া অন্য কোনো নাগরিক সেবার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে বাংলাদেশের নগরগুলো বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। সেজন্য দ্রুত বর্ধনশীল নগরের বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে টেকসই নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। জনগণের জন্য বাসযোগ্য করতে হলে সরকারের সকল পর্যায়ে সমন্বয়, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে নগরগুলিকে পরিকল্পনামাফিক পরিচালনা করতে হবে। বাংলাদেশে মোট সরকারি ব্যয়ের তুলনায় স্থানীয় পর্যায়ে ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় তিন শতাংশ, যা বৈশ্বিকভাবে নিম্নতম ব্যয়ের অন্যতম। তাই দেশের স্থানীয় পর্যায়ে অবকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়ানো দরকার। দ্রত নগরায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নগরোন্নয়নে একটি সেন্টার ফর এক্সিলেন্স চালু করা হয়, যেটি নগরগুলোর বাসযোগ্যতা উন্নয়নের লক্ষ্যে জ্ঞান-বিনিময় করবে এবং পৌরসভাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে। জিডিপি থেকে শুরু করে সব অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি ঘটছে। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। এমন পরিস্থতিতে নগর উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। দেশের সব অঞ্চলে সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। পৃথিবীর সবদেশেই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা হচ্ছে অথচ বাংলাদেশে এর উল্টো চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয় সরকারের জন্য যে বাজেট দেয়া হয় তা অনেক কম। তবে বর্তমান সরকার স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছে। তবুও অনেক সমস্যা রয়েছে। তবে সরকারের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পৌরসভা মেয়রদের নিজেদের আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ৩০৫টি পৌসভাকে নিজেদের সমস্যা নিজেদের মতো করে সমাধান করতে হবে। নিজেদের নগর কেমন হবে, তা জনগণের সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিকল্পনামাফিক নিজেদেরকেই গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু এসব কাজ বিদ্যমান নগর ব্যবস্থাপনা দ্বারা সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশে নগরগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং সেগুলোর কোনো স্ব-শাসন নেই। নেই নিজস্ব কোনো আয়ের ব্যবস্থা। প্রায় সকল উন্নয়ন কাজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নগরগুলোকে নির্ভর করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন নাগরিক সেবা ও আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সংস্থার ওপর নগরকর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে নগরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে পরিকল্পিত ও পরিবেশবান্ধক নগর গড়ে তুলার জন্য রয়েছে স্ব-শাসিত, স্বনির্ভর ও গণতান্ত্রিক নগর সরকার। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ, নগর বিশেষজ্ঞ, নগর পরিকল্পানবিদ ও সুশীল সামজের প্রতিনিধিগণ একরূপ নগর সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি করলেও রাজনৈতিক কারণে এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। যে যাই বলুক, পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগর গঠনে নগর সরকারের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই তা প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য নগর সংসদ, নগর নির্বাহিক বিভাগে ও নগরবিচার বিভাগের মাধ্যমে প্রত্যেক নগরে একরূপ নগর সরকার গঠন করতে হবে। গ্রামভিত্তিক সমাজব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ ক্রমেই নগরায়ণের দিকে যাচ্ছে। ফলে মানুষের জীবনযাপনের ধরন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের খাদ্যাভাস, আচার আচরণ, মন-মানসিকতা, পেশা ও প্রযুক্তির ব্যবহার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মাথাপিচু আয় ও গড় আয়ু বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ইতিবাচক পরিবর্তন।বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। নিম্ম মধ্যম আয়ের দেশ বলতে এমন দেশকে বোঝায়, যাদের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৪৬ থেকে চার হাজার ১২৫ মার্কিন ডলারের মধ্যে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬১০ ডলার। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, একটি দেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে তার মাথা পিছু আয় হতে হবে চার হাজার ১২৬ থেকে ১২ হাজার ৭৩৫ মার্কিন ডলারের মধ্যে। খুবই দ্রুত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে আমাদের পুঁজির সঠিক ব্যবহার করতে হবে। বাংলাদেশের পুঁজি হলো- মানব সম্পদ, অর্থসম্পদ, কৃষি সম্পদ ও খনিজ সম্পদ। উচ্চ মধ্যম আয়ে যেতে হলে শুধু পরিকল্পিত নগরায়ণ করলেই হবে না। এ জন্য এই চারটি সম্পদের সমন্বিত ব্যবহার করে শিল্প ও ব্যবসায় সফলতা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে উত্পাদনশীলতা, কর্মসংস্থান, সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। লেখক: কলাম লেখক |