শিরোনাম: |
জাগ্রত হোক ভ্রাতৃত্ববোধ
|
‘গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। নাই দেশ-কাল পাত্রভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি’ এই যে একটি চিরসত্য কথা নজরুল অবলীলায় বলেছেন, ‘অভেদ ধর্ম জাতি।’ আসলে এই কয়েকটি লাইন পড়লেই মধ্যযুগের কবি বড়ু চণ্ডীদাসের সেই অমীয়বাণী কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হয়- ‘ শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ ফকির লালন সাঁইয়ের কথায়- ‘এমন মানব সমাজ কবেগো সৃজন হবে যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে।’ এই মানুষ আমরা, একে অপরের ভাই। ভাই ভাই হিসেবে চলাফেরা করাটাই হলো আমাদের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। আমরা সবাই যদি সমাজে আমরা ভ্রাতৃত্বেবাধ নিয়ে চলাফেরা করি তাহলে আমাদের মধ্যে কোনো হিংসা বা বিদ্বেষ জন্মাতে পারবে না। কিন্তু যখন আমাদের চলার মধ্যে হিংসা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি হবে তখন আমাদের মধ্যে রাহাজানি, মারামারি কলহের সৃষ্টি হবে। শুরু হবে আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, মারামারি, রাহাজানিসহ আরও নানা ধরনের কলহ। যেটা কোনো মানব সমাজের জন্য কাম্য হতে পারে না। আমাদেরকে বিধাতা সৃষ্টি করেছেন মারামারি বা রাহাজানির জন্য নয়। এ পৃথিবীতে আমরা যত ধর্মের দিকে খেয়াল করি দেখি, কোনো ধর্মই মানুষ হত্যা করা সমর্থন করে না। তাই যদি কোনো ধর্মই হত্যা সমর্থন না করে তাহলে আমরা কেন মারামারি, রাহাজানি সৃষ্টি করে মানব সন্তানকে হত্যা করার কাজে লিপ্ত হলাম। এটা থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে। কারণ আমরা মানব সন্তান, আমাদের মরতে হবে। মরার পর আমাদের সব মানব জাতিকে বিধাতার কাছে আমাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তাই আমাদের সব মায়ের সন্তানকে এই বাংলার আলো-বাতাসে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করতে হবে। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা আমাদের বাংলাদেশ। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খ্রিস্টান, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের বসবাস। আমরা সবাই একই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ। একে অন্যের ভাই, বন্ধু, আপনজন। ইদানীং কতিপয় বিপথগামী তরুণ-তরুণীর জন্য সেই পরিবেশ নোংরা হতে চলেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা কখনোই মেনে নেয়া যায় না। ধার্মিক হওয়া ভালো। তবে ধর্মান্ধতা কখনোই কাম্য নয়। ধর্মকে পুঁজি করে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ-অরাজকতা সৃষ্টি করা কারোরই কাম্য হতে পারে না। দেশের রাজনীতিকে উদ্দেশ্য করে দেশের মানুষের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করা কোনো সভ্য দেশ বা মানুষের কাম্য হতে পারে না। দেশ কার দ্বারা পরিচালিত হবে সেটা আল্লাহ হতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। দেশের মানুষ হত্যা করে বা দেশের মানুষের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়া কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। দেশের মধ্যে ও দেশের মানুষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সব ধর্মেরই কথা। আমি মহাপুরুষ মুহম্মদ (স.)-এর জীবনী পড়েছি। আরও মহান মনীষীর কথাও জানি। তারা কখনো বলেননি, মানুষ হত্যা করে, মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে বেহেশতে যাওয়া যায় বা পাওয়া যায় হুরপরীদের সান্নিধ্য। তারা বরং মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে সাহায্য করার কথা বলেছেন। বিপদে-আপদে একজনের পাশে আরেকজনকে দাঁড়াতে বলেছেন। প্রতিটা ধর্মের মূল কথা হলো- শান্তি। চুরি না করা। পাপ কাজ না করা। বিনা প্রয়োজনে জীব হত্যা না করা। মিথ্যা কথা না বলা। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে আজ আমরা মানবজাতি নিজেদের ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছি। একে অন্যের সঙ্গে অহেতুক হানাহানিতে লিপ্ত হচ্ছি। ছোটবেলা থেকেই শিশুদের স্বচ্ছ ধারণা দেয়া প্রয়োজন। এক একটি পরিবার যদি এক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে তবে বড় হয়ে সেই শিশু অনৈতিক কাজে জড়িত হতে পারে না। নৈতিকতার শিক্ষাটা শুরু হতে হবে পরিবার থেকেই। এরপর সমাজে। সর্বশেষ আসে রাষ্ট্রের কথা। আমি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। কিন্তু সব ধর্মের মানুষকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করি, সব ধর্মকেও আমার নিজের ধর্মের মতোই সম্মান করি। পবিত্র মনে করি, ভালোবাসি। ছোটবেলা থেকেই আমি বড় হয়েছি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত পরিবেশে। আমার প্রিয় বন্ধুদের ব্যাপারে যদি কেউ জিজ্ঞেস করেন, তাহলে সেই তালিকায় আমার এমন অনেক বিশ্বস্ত-উপকারী ও প্রকৃত বন্ধুর নাম উঠে আসবে, যারা কেউই আমার ধর্মের অনুসারী নয়। তবুও আমরা বন্ধু। প্রাণের বন্ধু। যে বন্ধুদের মাঝে ধর্ম-বর্ণ-জাত কোনো বাধা হয়ে উঠতে পারেনি। ভবিষ্যতেও তা হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। আমরা যদি এ ভাবে চিন্তা করি যে, আমরা বাংলা মায়ের প্রতিটি সন্তানই একে অন্যের ভাই। একে অন্যের বন্ধু। একে অন্যের শুভাকাঙ্ক্ষী। তাহলে বোধহয় অধর্মের অন্ধকার দিকগুলো আষ্টেপৃৃষ্ঠে জড়াতে পারবে না। ধর্মই আমাদের শিখিয়েছে উদার হতে। এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে শ্রদ্ধা করতে। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ না হয়ে আমাদের পরিচয় হওয়া উচিত মানুষ। আমরা সবাই একই মায়ের সন্তান। বাংলা মায়ের সন্তানই হোক বড় ও প্রধান পরিচয়। সংগৃহীত একটি গান দিয়েই শেষ করছি- মন্দির ভাঙ্গো আর মসজিদ ভাঙ্গো/সেগুলো তো গড়া যাবে।/কেন মানুষ মারো/তাকে কি কখনো পাওয়া যাবে?/ও বন্ধু, কেন বোঝো না/আমরা সবাই এক মায়ের ছেলে/হাজার হাজার মরেছে মানুষ/এই পৃথিবীতে,/হাজার মায়ের বুক হয়েছে খালি/ ধর্মের লড়াই করে।/ তুমিও মানুষ আমিও মানুষ/কেন ভেদাভেদ করো পৃথিবীতে।/ ও বন্ধু, কেন বোঝো না/ আমরা সবাই এক মায়ের ছেলে/জনম জনম হিন্দু-মুসলিম/থাকবে জগতে/জনম ধরে থাকবো মোরা/একই স্রষ্টার ছায়াতে/ আল্লাহ বলো ভগবান বলো/কেন ভেদাভেদ করো পৃথিবীতে।/ও বন্ধু, কেন বোঝো না/আমরা সবাই এক মায়ের ছেলে। পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, আমরা বিধাতার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আর এই শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে আমাদের বিবেক-বুদ্ধিও শ্রেষ্ঠ। ভালো-মন্দের বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। তাই আমাদের মধ্যে যে ভুল-ভ্রান্তি রয়েছে তা ভুলে গিয়ে শান্তির পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। |