হায়রে বার্মা!
Published : Monday, 18 September, 2017 at 9:24 PM, Count : 3504

লিয়াকত হোসেন খোকন : তখন আমার বয়স কতই-বা হবে, এই ৭ বছর। ১৯৫৯ সাল। পিরোজপুরের ইরা টকিজে চলছিল ‘বর্মার পথে’ ছবিটি। বর্মাকে তখন আমরা বলতাম ‘বার্মা’। তার পরে নাম হলো মিয়ানমার। ইরা টকিজে প্রদর্শিত ‘বর্মার পথে’ ছবিটি দেখার জন্যে প্রতিদিনই দর্শকের ভিড় লাগতো, বাবার হাত ধরে ইভিনিং শোতে গেলাম ‘বর্মার পথে’ দেখতে। বার্মার জনমানবহীন গভীর বন, রেঙ্গুন শহর রূপালি পর্দায় দেখে সেই প্রথম বার্মার প্রতি দুর্বলতা জেগে উঠল। ভাবতাম, খুব করেই ভাবতাম কী করে বার্মায় যাওয়া যায়। ১৯৪০ সালের আগে বহু বাঙালি পরিবার বার্মায় বিভিন্ন শহরে চাকরির সুবাদে ওখানে বসবাস করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেই ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে জাপানি বিমানের আক্রমণ শুরু হয় বার্মায়। তখনই বাঙালি পরিবারগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানহীন হয়ে বার্মা ছেড়ে স্বদেশ বাংলায় ফিরে আসতে থাকেন। তখন অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে সঙ্গে স্ত্রী, পুত্র, কন্যাকে নিয়ে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে আসতে গিয়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কেউ শিশুসন্তানকে বয়ে নিয়ে যেতে না পেরে ফেলে যায় বার্মার গভীর বনে। কীই না-নিদারুণ দিনগুলো কেটেছিল বার্মাবাসী বাঙালিদের! ‘বর্মার পথে’ ছবিতে এরকম দৃশ্য দেখে বার্মা দেশটিকে জানার জন্য আমি খুবই উত্সুক হলাম। আর ‘পতাঙ্গা’ ছবিতে শামসাদ বেগমের গাওয়া ‘মেরে পিয়া গায়ি রেঙ্গুন উহা ছে টেলিফোন আয়া’ গানের দৃশ্যে নায়িকা নিগার সুলতানাকে দেখে ছবিঘরের প্রতিটি দর্শক এই গানে ঠোঁট মিলাতেন। ‘রেঙ্গুন-রেঙ্গুন’ নিয়ে সে কি হৈচৈ। তারপর দিন কেটে যায়। 
১৯৮৪ সাল তখন। কক্সবাজার হয়ে টেকনাফে বেড়াতে গেলাম ৩ বন্ধু মিলে। টেকনাফের এক হোটেলে বসে জব্বার বলল, তালেব চল-না বার্মা থেকে ঘুরে আসি। নাফ নদী পেরুলেই বার্মা অর্থাত্ এখন এর নাম মিয়ানমার। জব্বারের কথায় সায় দিয়ে তালেবকে বললাম, কী আছে ভাই একটি চান্স নিয়ে দেখি-না, কোনোভাবে মিয়ানমারে যাওয়া যায় কি না। নাফ নদী পেরিয়ে ওপারে মিয়ানমারের কাছাকাছি আসতেই আমাদের ইচ্ছাটির কথা এ পারের সীমান্তপ্রহরীর সঙ্গে আলাপ করতেই তারা জানালেন, ৭ দিনের বেশি মিয়ানমারে থাকা যাবে না কিন্তু। এপারের সীমান্তপ্রহরী আমাদের ওপারের সীমান্তপ্রহরীর কাছে নিয়ে এলো। দু’দেশের সীমান্তপ্রহরীদের অনুমতি নিয়ে ছুটলাম বার্মা দেখতে। 
এককালে বাঙালিরা প্রায়ই রেঙ্গুন যেতেন। কাজের সন্ধানে বার্মা যাওয়া বাঙালির বোধহয় পানি-ভাতের মতোই সহজ ছিল। অনেকে বার্মার স্থায়ী বাসিন্দাও হয়ে গিয়েছিলেন। তারপর এই যাতায়াত নানা কারণে কমে যায়। আমরা প্রথমে এলাম ইয়াঙ্গুন শহরে। এখানের রাস্তাঘাট অনেকটাই আমাদের দেশের মতো, কিন্তু রাস্তার ধারে গাছপালা অনেক বেশি। ট্রাফিকের লাল আলোয় গাড়ি থামতেই অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা বেলফুল, জুঁইফুল, দোলনচাঁপার মালা বিক্রি করার জন্য গাড়ির কাছে চলে এলো। ওদের গালে চন্দনের মতো কী যেন মাখানো। গাড়িচালককে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, এরা তানাখা মেখেছে, তানাখা হলো একরকম গাছের ছাল যা আমাদের চন্দনের মতোই পাটায় বেটে এরা সর্বক্ষণ মুখে মাখে, মেয়েরা মুখে মাখার পর আবার ডিজাইনও করে। তানাখার আসল কাজ রোদ থেকে ত্বককে বাঁচানো। তানাখা বেটে একটু খেলেও তাতে নাকি শরীর ঠাণ্ডা থাকে। ইয়াঙ্গুন শহরের প্রাণকেন্দ্রে চারদিকে অনেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা দেখলাম। সবচেয়ে বড় বাড়িটি সিটি হল, এখানে এখন সরকারি অফিস, যেন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মতো। সদাচঞ্চল এই সুলে প্যাগোডার চারধারে অসংখ্য ছোটবড় দোকানপাট। নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে এখানে। আমাদের হোটেলের খুব কাছেই সুলে প্যাগোডা। আড়াই হাজার বছরেরও আগে তৈরি হয়। সুলে প্যাগোডার চারধার দেখে আমরা রওনা হলাম ইয়াঙ্গুন নদীর দিকে। এখানে এসে মনে হল, এ যেন ভীষণ ব্যস্ত বন্দর। নদীর কাছেই বোটাধঙ্গ প্যাগোডা। বলা হয় এটিই শহরের সবচেয়ে পুরনো প্যাগোডা। আড়াই হাজার বছরের পুরনো, স্তূপ ও মন্দিরের মিশ্রণে নির্মিত একটি সুড়ঙ্গের মধ্যে ছোট ঘরে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দুটি কেশ রাখা আছে।
১৯৩৮ সালে বার্মা এবং ভারতবর্ষ ইংরেজের শাসনে সুবিধা করার জন্য আলাদা হয়ে গেল। নাটক-নভেল পড়ার সেই উঠতি বয়সে শরত্চন্দ্র ছিলেন আমাদের প্রিয় উপন্যাসিক। শরত্চন্দ্র বার্মাকে আমাদের কাছে এনে দিয়েছিলেন। আর পাঁচজন বাঙালি ভাগ্যান্বেষীর মতো শ্রীকান্তও বার্মা গিয়েছিল। তার বাসস্থান রেঙ্গুনের বাঙালিপাড়ায়। রবীন্দ্রনাথের জাপান যাত্রীতেও রেঙ্গুনের উল্লেখ আছে, কিন্তু তিনি সেখানে মাত্র একদিন ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষভাগে বার্মা খবরের চূড়ায় উঠে এল। সেই সময় দক্ষিণভারতের চেট্টিসাররা বার্মায় ব্যবসা-বাণিজ্যে জমিয়ে ছিল। জাপানিরা যত এগোতে লাগল, বাঙালিরা আর চেট্টিসারেরা তত দ্রুত বার্মা ছাড়তে লাগলেন। সেই যুগে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে বার্মায় যাওয়া যেত। আবার অনেকেই পায়ে হেঁটে বার্মায় যেতেন। এজন্য তাদের ভয়াল নির্জন পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে বার্মায় যেতে হত। বার্মা স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে, এর পরেই এই জায়গা অশান্ত হতে থাকে। ওখানেই জনগণের প্রিয় নেতা আটংসানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এর পর থেকে বার্মায় শুরু হয় সামরিক শাসন। অতঃপর ট্যুরিস্টরা ওই সময়ের পরে আর বার্মায় যেতে চাইত না। বার্মা গিয়েছি মনের তাগিদে। শুধুই ওখানের প্রাকৃতিক সবুজ আর নীল আকাশ দেখবার জন্যই কিন্তু। বার্মায় গিয়ে প্রশ্ন জেগেছে, বার্মা বদলে মিয়ানমার হলো কেন? আগে নাম ছিল রেঙ্গুন। এখন নাম ইয়াঙ্গুন। ‘রেঙ্গুন’ নামটি খুবই সুন্দর ছিল অথচ তা পালটে ‘ইয়াঙ্গুন’ যারা করেছেন তারা কী যুক্তিতে করেছেন এটিও বুঝতে পারলাম না। আমরা যখন বার্মায় গেলাম তখনও বার্মা কিন্তু অশান্ত ছিল। 
ইয়াঙ্গুনে ২ দিন থাকার পর এলাম মান্দালে। মান্দালে একদা রাজধানী ছিল। কেউবা একে বলে মান্দালয়। বড় শহর। ইংরেজরা রেঙ্গুনে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যায় ঊনিশ শতাব্দীর শেষভাগে। উত্তর মিয়ানমারের প্রধান শহর মান্দালে। এখানে এক হোটেলে উঠলাম। মধ্যাহ্নভোজনের পর আমরা মান্দালে শহর দেখতে বেরোলাম। শহরের কেন্দ্রে মান্দালে পাহাড়, এটি নাতিদীর্ঘ পাহাড়। বোধহয় হাজারখানেক সিঁড়ি ভাঙতে হয়। এতে লিফট আছে। দেখলাম পাহাড়ের মাথায় একটা অতি সুদৃশ্য প্যাগোডা। সুন্দর স্থাপত্য-ভেতরে রঙ্গের  বাহার। উপর থেকে সারা মান্দালে শহর দেখা যায়। বিশাল প্রাসাদের কাছ থেকে যাওয়ার সময় বারবার শেষ রাজা থিবোরের কথা মনে পড়ল। ১৮৮৫ সালে থিবোকে পরাজিত করে ইংরেজ মান্দালে এবং উত্তর বার্মা অধিকার করে নেয়।
দক্ষিণ বার্মা অবশ্য আগেই ইংরেজরা দখল করে নিয়েছিল। থিবোকে ইংরেজ শাসক ভারতবর্ষে নির্বাসিত করেছিল। মান্দাল দেখা শেষ করে পরদিন সকালে বাগানের উদ্দেশে রওনা হলাম। বাগানে যাওয়ার আগে দুটি প্যাগোডা দেখা হল। ওখান থেকে এলাম নদীর তীরে সোয়া কিলোমিটার লম্বা কাঠের সেতুর কাছে। কাঠের খামের ওপর সেতুটি ভর করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক শতাব্দী ধরে। এখানের পথটি মনোরম ছিল-সবুজের মধ্য দিয়ে, নির্জন, বড় গাছের সারি। সেতুর মুখেই দেখলাম, বেশ কিছু লোক প্যাঁচা বিক্রি করছে। স্টিমারে ইয়াবতী নদী পাড়ি দিয়ে বিকেলের দিকে এসে পৌঁছলাম বাগানে। বাগান একদা হাজার বছর আগে বার্মার রাজধানী ছিল। সম্ভবত ভক্তির যুগ ছিল তখন। বাগান থেকে রাজধানী কবেই  চলে গেছে, কিন্তু থেকে গেছে সাড়ে সাত হাজারের অধিক প্যাগোডা, মন্দির ও মঠের ধ্বংসাবশেষ। এখানে এসে মনে হলো, জনহীন প্রান্তরের মাঝখানে পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে সেকালের মানুষদের কীর্তির চিহ্ন দাঁড়িয়ে আছে। দেখলাম, ছোট, তিন-চার ফুট উঁচু মন্দির, উঁচু একশো ফুট প্যাগোডা। কয়েকটিতে এখনও পূজাপার্বণ হয়। সেখানে লোকসমাগম। বাগানের একটি অংশ আধুনিক। ইট-কাঠের বসতবাড়ি, দোকানপাট। এক সন্ধ্যায় ছোট স্টিমারে ইরাবতী নদীতে জলবিহার করেছিলাম। এদিকে সন্ধ্যা নেমে এল। তখন দুই তীরে তাকাতেই দেখি বিন্দু বিন্দু আলো জ্বলছে আর নিভছে। কেমন জানি ভয়-ভয় লাগছিল। মাউন্ট পোকা দেখার স্মৃতিও ভোলা সম্ভব নয়। মাউন্ট পোকা দেখার জন্য হাজার ফুট উঁচুতে উঠলাম। জানলাম, লাভাস্রোত ঠাণ্ডা হওয়ার পর এই উচ্চভূমি তৈরি হয়েছে। কাছেই দেখলাম পোপা আগ্নেয়গিরির চূড়া। এই আগ্নেয়গিরি নির্বাপিত হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। এর চারপাশে সবুজে আচ্ছন্ন দেখে তাকিয়ে ছিলাম। ওখানের সামরিক শাসনের কথা ভেবে ভাবলাম, তা হলে এদেশটি স্বাধীন হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? ইংরেজদের অধীনে থাকার বার্মার সেই দিনগুলেইা তো ভালো ছিল। আজ এও দেখছি সেনাদের হাতে বর্ববরভাবে নির্যাতিত ও নির্বিচারে খুন হচ্ছে রোহিঙ্গারা। বাড়িঘর পুড়িয়ে, নারীদের ধর্ষণ আর শিশুদের নির্মমভাবে মেরে দেশ দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে তাদের।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


সর্বশেষ সংবাদ
সর্বাধিক পঠিত
সম্পাদক ও প্রকাশক: আলহাজ্ব মিজানুর রহমান, উপদেষ্টা সম্পাদক: এ. কে. এম জায়েদ হোসেন খান, নির্বাহী সম্পাদক: নাজমূল হক সরকার।
সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক শরীয়তপুর প্রিন্টিং প্রেস, ২৩৪ ফকিরাপুল, ঢাকা থেকে মুদ্রিত।
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : মুন গ্রুপ, লেভেল-১৭, সানমুন স্টার টাওয়ার ৩৭ দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা-১০০০ থেকে মুদ্রিত।, ফোন: ০২-৯৫৮৪১২৪-৫, ফ্যাক্স: ৯৫৮৪১২৩
ওয়েবসাইট : www.dailybartoman.com ই-মেইল : [email protected], [email protected]
Developed & Maintainance by i2soft