শিরোনাম: |
ভূত ধরার অভিযান
|
মুন্নাও নিয়ন্ত্রণহীন জীবন পেয়ে উদ্দিস মোল্লার মতো জীবনটাকে উপভোগ করছে। সারাদিন টইটই করে এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে দিন পার করে। মাথায় যখন যেটা ভূত চাপে তখন সেটাই করে বা করার চেষ্টা করে। এবার মাথায় চেপেছে, ডলার ও আক্কেল কবিরাজকে সঙ্গে নিয়ে ভূত ধরার অভিযানে বের হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ভূত ধরার অভিযানের জন্য জায়গাও ঠিক করে ফেলেছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর বনে যাবে। ভূতের ছবি এবং ভিডিও করার জন্য দামি ডিজিটাল ক্যামেরা, ও টিভি ক্যামেরাও সঙ্গে নিয়েছে। এ অভিযান তিন দিনব্যাপী চলবে। ভূত ধরার উপযুক্ত স্থান বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত এবং উপযুক্ত সময় গভীর রাত। মুন্না নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে রাত ৮টার সময় মধুপুরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করে। প্রাইভেট কারটি গাবতলী হয়ে সাভার অতিক্রম করে নবীনগর হয়ে যখন কালিয়াকৈর পৌঁছে, তখন রাত প্রায় ১১টার মতো বাজে। আরিচা রোডে জ্যাম থাকার কারণে কালিয়াকৈর আসতে একটু বেশি সময় নিয়েছে। কালিয়াকৈর এসে মুন্না, ডলার ও আক্কেল কবিরাজ হোটেলে রাতের ডিনার খেতে শুরু করে। আক্কেল কবিরাজ মুন্না ও ডলারকে অনুরোধ করছে, মাছ মাংস দিয়ে ভাত না খাওয়ার জন্য। কবিরাজের ভাষ্য হলো মাছ, মাংস দিয়ে ভাত খেলে ভূতেরা মানুষদের আক্রমণ করে। কবিরাজের কথা শুনে মুন্না হা, হা করে হাসতে থাকে। কবিরাজ চাচা আপনি কি বলেন, ভূত আমাদের ওপর আক্রমণ করবে। ভূত আক্রমণ করলে করুক। আমরা তো সেটাই চাই, ভূত আমাদের ওপর বেশি করে আক্রমণ করুক। মুন্না বাহিনী এরপর খাওয়া দায়া শেষ করে মধুপুর পৌঁছে রাত ২টার পর। এরপর ধীরে ধীরে মধুুপুর শহর শেষ করে বনের ভেতরে গাড়ি প্রবেশ করে। গাড়ি বনের ভেতরে আঁকা বাঁকা উঁচু নিচু পথ দিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে। শিয়ালের ডাক শুনে ডলার একটু ভয় পেয়ে যায়। কিছু দূর যাওয়ার পর মানুষের চিত্কার শোনা যাচ্ছে। মুন্না মানুষের চিত্কার শুনে বলে, এত রাতে বনের ভেতরে মানুষের চিত্কার আসে কোথা থেকে? আক্কেল কবিরাজ বলে, তুমি বুঝবা না বাবাজি। এগুলো সব ভূতের কাণ্ড। আমাদের ভয় দেখানোর জন্য ভূতেরা এসব কাজ করছে। দেখতে দেখেতে বনের ভেতরে জলছত্রে মুন্নারা চলে এসেছে। গাড়ি পেছন দিক থেকে কে যেন টেনে ধরে রেখেছে। কোনো অবস্থাতেই মুন্না গাড়িটাকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারছে না। অগত্যা জলচত্র পিকনিক স্পটে একটা রেস্টহাউসে ওঠে রাতটা পার করে দেয়। ভূত ধরার অভিযানের দ্বিতীয় দিনে সবাই সারাদিন ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। রাত ১২টায় মুন্না বাহিনী রেস্টহাউস থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ভূত ধরতে বের হয়। এবার ওরা গাড়ি নেয়নি। পায়ে হেঁটেই ভূত ধরতে বের হয়েছে। জলছত্র থেকে ওরা হেঁটে হেঁটে তিলকির দিকে যাচ্ছে। যত ভেতরের দিকে যাচ্ছে, বন তত ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। কবিরাজের হাতে চার ব্যাটারির টর্চ লাইট, মুন্নার হাতে টিভি ক্যামেরা, ডলারের হাতে ক্যামেরা। মুন্না একটু দূরে তাকিয়ে দেখে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে সাদা ঘোড়া দৌড়াইয়া আসতেছে। ঘোড়া দৌড়াইয়া আসতে দেখে মুন্না ভয়ে টিভি ক্যামেরাটা মাটিতে ফেলে দেয়। মুন্নার বেগতিক অবস্থা দেখে কবিরাজ আল্লাহর নাম নিয়ে কোরআন শরিফের বিভিন্ন সুরা পড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর দেখে পেছন দিক থেকে ৪/৫টা শিয়ালের দল আসতেছে মুন্না বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য। শিয়াল আসতে দেখে ওরা তিনজনই খুব ভয় পেয়ে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই ওরা নিজেদের সাহস সঞ্চয় করে। মরতে হলে একসঙ্গে মরব, বাঁচতে হলে একসঙ্গে বাঁচবো। শিয়ালের দলকে প্রতিহত করার জন্য তিনজনের প্রত্যেকের হাতে বিশাল বড় বড় লাঠি আছে। কবিরাজ চার ব্যাটারির টর্চ লাইট শিয়াল দলের চোখ বরাবর ধরে রেখেছে। এরপর শিয়ালগুলো আর ওদের পিছু নিল না। কিছুক্ষণ পরে ওরা তিনজন পেছনে ফিরে দেখে, শিয়ালের লেশমাত্রও ওইখানে নেই। শিয়ালকে না দেখতে পেয়ে মুন্না কবিরাজকে বলে, কবিরাজ আংকেল ওরা কী তাহলে ভূত ছিল? ওরা হয়তো ভূতই ছিল। কারণ ভূতেরা বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। এ দিকে মুন্নার টিভি ক্যামেরা নিচে পড়ে যাওয়ার কারণে, ওটি আর কাজ করছে না। মুন্না এ জন্য বেজায় নাখোশ। তিলকির খুব কাছাকাছি ডলার দেখতে পায়, কয়েকটা ছাগল পা ছাড়াই হেঁটে যাচ্ছে। ডলার ভয় পেয়ে কবিরাজের গলা জড়িয়ে ধরেছে। কবিরাজ বুঝতে পেরে বলে, কি হয়েছে ভাতিজা? ভূত ধরতে এসে ভয় পেলে হবে। ডলার পা বিহীন ছাগলগুলো কবিরাজকে দেখাতে গেলে, দেখে ওইখানে কিছুুই নেই। কবিরাজ বলে, তুমি যা দেখেছো, তা এক ধরনের ভূত ওরা এই আছে আবার দেখবে নাই। রাত প্রায় ৩টার মতো বাজে। মুন্না ও ডলার দুজনই ভয় পাচ্ছে। এতক্ষণে তিলকিতে চলে এসেছে। হঠাত্ ভীষণ ঝড় শুরু হয়ে গিয়েছে। ওরা তিনজন পরস্পরকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। ঝড়ের প্রচণ্ড দাপটে ওরা মোটেই পেরে উঠছে না। মনে হয়, এই বুঝি তিনজন শূন্যে উড়ে যাবে। এরপর কিছুক্ষণ পর ঝড় থেমে যায়। তিনজনেরই ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। ব্যাগের ভেতর ৩টা স্যান্ডউইচ ও মিনারেল ওয়াটার ছিল। তিনজনই একটা গাছের নিচে বসে স্যান্ডউইচ খেয়ে পানি পান করে নিল। ওরা তিনজনই খুব ক্লান্ত। এরপর তিলকিতে টাবু টাঙিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এক ঘুমে রাত পার হলে সকাল হয়ে যায়। ভোর বেলায় বনের আশপাশের মানুষজন এসে ওদের তাবুর চারপাশ ঘিরে ধরে। সমস্ত লোকজন সার্কাস দেখার মতো করে ওদের দেখছে। মুন্নাদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল ৮টার মতো বেজে যায়। ওরা ঘুম থেকে উঠে দেখে, ওদের চারপাশ ঘিরে রেখেছে অনেক লোক। মুন্না চোখ কচলাইতে কচলাইতে বলে, ভাই আপনারা কারা? উপস্থিত লোকজনদের মধ্যে জনৈক এক ব্যক্তি মুন্নাকে পাল্টা প্রশ্ন করে, আপনারা কারা? কোন দুঃখে এই গভীর জঙ্গলে এসেছেন! আমরা দিনের বেলাতেও এই মুখ হওয়ার চেষ্টা করি না। আর আপনারা এখানে রাত থেকে ঘুমিয়ে আছেন। আপনাদের সাহস তো কম না! মুন্না জনৈক লোকের কথা শুনে বলে, ভাই ঠিকই বলেছেন। আমরা প্রচণ্ড সাহস নিয়েই এখানে এসেছি ভূত ধরতে। ভূত ধরার কথা শুনে জনৈক লোকটি অবাক হয়ে বলে, আপনাদের মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে। ভূতকে কি কখনো ধরা যায়? আপনারা জানেন না ভাইসব, আমরা ভূত ধরার জন্য কবিরাজকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। জনৈক লোকটি আবারও বলে, একশ কবিরাজ নিয়ে আসলেও ভূতকে ধরতে পারবেন না। ভূত ধরা কি এত সহজ কাজ। অকালে জানটা না হারিয়ে মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যান। আমরা যাব, তবে একদিন পাব। আমাদের হাতে আজ রাত পর্যন্ত সময় আছে। দেখি আজ রাতে অন্তত একটা ভূত ধরার চেষ্টা করি। একটা ভূতও যদি ধরে না নিয়ে যাই, তাহলে ঢাকায় গিয়ে এই মুখটা দেখাবো কি করে। জনৈক লোকটি মুন্নার ভূত ধরার প্রচণ্ড ইচ্ছা দেখে বলে, আপনি সত্যি সত্যি ভূত ধরতে চান। হ্যাঁ, আমি সত্যি সত্যি ভূত ধরতে চাই। তাহলে রসুলপুরের দিকে গাবতলা শ্মশানঘাটের দিকে যান। ওইদিকে প্রচুর পরিমাণে ভূতের দেখা পাবেন। এরপর মুন্না, ডলার ও কবিরাজ যথারীতি দিনে ঘুমিয়ে রাত ১২টার সময় রসুলপুরের দিকে রওনা দেয়। তিলকি থেকে রসুলপুরের দিকে যেতে ওদের তেমন কোনো বেগ পেতে হয়নি। রাস্তায় চলার পথে শিয়াল, ছাগল, বিড়াল কোনো কিছুরই দেখা পায় নাই। তবে কিছুক্ষণ পরপর একটা শো শো আওয়াজ পাচ্ছে। মাছের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, কবিরাজ বলে, ভূতরা সকলে মিলে কাঁচা মাছ খাচ্ছে। হঠাত্ ডলার বলে, কবিরাজ আংকেল, ভূতেরা কাঁচা মাছ খায় কেন? ডলারের প্রশ্নের উত্তরে কবিরাজ বলে, ভূতেরা সবকিছু কাঁচা খেতে পছন্দ করে। এরমধ্যে কাঁচা মাছ তাদের খুব প্রিয় খাদ্য। মুন্নারা তিনজন হাঁটতে হাঁটতে প্রায় গাবতলা শ্মশানঘাটের দিকে চলে এসেছে। শ্মশানঘাটের কাছে আসার পর মুন্নারা তিনজনই অনবরত কাঁপছে। হঠাত্ মানুষের কণ্ঠের মতো একটা কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে আসছে। তোমাদের তিনজনকে আমাদের ভূত সমাজে স্বাগতম। আমরা শুনেছি তোমরা আমাদের ধরে নিয়ে যাবে, এ কথা বলে, জোরে অট্টহাসিতে আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মুন্নারা তিনজনে ভয়ে ওদের হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। হঠাত্ কোনো শব্দ নেই। চারিদিক নীরব হয়ে গেছে। তিনজনের মধ্যে কবিরাজের অবস্থা খুবই খারাপ। ভয়ে কবিরাজ চোখ উল্টাইয়া দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে মুন্না ও ডলার কবিরাজের চোখে মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। ওরা তিনজন ভয়ে ভয়ে গাবতলা শ্মশানঘাট পার হয়ে আসার পর ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসে। এরপর ওরা তিনজন বহু কষ্টে রসুলপুর থেকে ভ্যান গাড়িতে করে জলছত্রে চলে আসে। জলছত্রে এসে রেস্টহাউসে উঠে তিনজন গোসল করে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। তিনজন মিলে তওবা করে, আর কোনো দিন ভূত ধরতে কোথাও যাবে না। এরপর সকাল ১০টার দিকে সঙ্গে আনা সব জিনিসপত্র নিয়ে তিনজনই গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি যথারীতি মধুপুর ছেড়ে পোড়াবাড়ি হয়ে ঘাটাইল, কালিহাতী, ইছাপুর, টাঙ্গাইল শহর অতিক্রম করে দুপুর ২টার দিকে ঢাকায় পৌঁছে। ঢাকায় গিয়ে ওরা তিনজনই মুখে তালা দিয়ে দেয়। |