শিরোনাম: |
কবি বন্দে আলী মিয়া
|
কবি বন্দে আলী মিয়া পাবনার শহরতলীস্থ রাধানগর গ্রামে ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্সী উমেদ আলী মিয়া এবং মা নেকজান নেসা। বাবা-মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান তিনি। অতি অল্প বয়সে বাবা তাকে বাড়ির নিকটবর্তী মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি করে দেন। লেখাপড়ার দিকে যত খেয়াল, তার চেয়ে বেশি ঝোঁক ছবি আঁকার দিকে। স্কুলে পড়াকালে ছবি এঁকে তিনি শিক্ষক মহোদয়দের প্রশংসা অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে ছবি আঁকার কাজে যতটা না তিনি পরিচিত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি খ্যাতি লাভ করেছেন কবি হিসেবে। বেশি সুনামের অধিকারী হয়েছেন শিশুসাহিত্য রচনা করে। কবি বন্দে আলী মিয়া পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি হতে ১৯২৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর কলকাতায় গিয়ে ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন। সেই সময় এই একাডেমিতে তিনিই একমাত্র মুসলিম ছাত্র ছিলেন। চিত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ছবি আঁকার কাজে মনোনিবেশ করলেন। এই সময় অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। খাঁ সাহেবের কথামতো করটিয়া সাদত কলেজে তিনি আইএ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু কলকাতার জীবন ছেড়ে মফস্বল শহরে কবির মন বসল না। লেখাপড়ার পাঠ শেষ না করেই কলকাতায় ফিরে যান। কলকাতায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে চলেছেন। লেখার পারিশ্রমিক যা পান তা দিয়েই নিজের চলে যায়। এক সময় কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন। দীর্ঘ সময় শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত থাকার পর দেশ বিভাগের (১৯৪৭) কারণে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকায় এসে ঢাকা রেডিও কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বই লিখে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কবিতা, ছড়া-গল্প লিখে, ছবি এঁকে সংসার চালাতে লাগলেন। ১৯৬৫ সালে রেডিওতে পাণ্ডুলিপিকার হিসেবে চাকরি নিয়ে রাজশাহীতে আসেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজশাহী রেডিওর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২৭ জুন তিনি রাজশাহীর কাজীহাটার বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। কবি নিজেই বর্ণনা করেছেন তার ‘জীবনের দিনগুলি’ গ্রন্থটিতে বলেছেন, ‘বাংলা ১৩২৮ সালের কথা। আমি সে সময়ে বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কবিতা লিখবার চেষ্টা করি। অতিশয় সঙ্কোচ আর লজ্জা। সহপাঠী বন্ধুদের দেখলে তারা মনে করবে, হয়তো কোনো বই থেকে কারো লেখা নকল করে বাহবা নেবার জন্য তাদের কাছে আমার নিজের বলে বলছি। তবুও লিখি এবং খাতাটা সযত্নে লুকিয়ে রাখি।’ এভাবে চেষ্টা করে যাবার পর সত্যি কবির কবিতা একদিন ছাপা হলো। তার জীবনের প্রথম ছাপা কবিতাটির নাম ‘ছিন্নপত্র’। রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলা থেকে প্রকাশিত ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি গেজেট’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় তার এই কবিতাটি ছাপা হয়। কবিতা প্রথম ছাপা হলে সে যে কী আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা সত্যি দুঃসাধ্য। এমনিভাবে আনন্দের মধ্য দিয়ে যার জীবন শুরু তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের জন্য লিখে গেছেন। ১৯২৭ সালে ‘চোর জামাই’ নামে শিশুদের উপযোগী তার প্রথম গ্রন্থ কলকাতা হতে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের ছবিগুলো বন্দে আলী মিয়া নিজেরই আঁকা। বই প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবি সবার কাছে পরিচিতি লাভ করলেন। তিনি গানও রচনা করতেন। তার ইসলামি গান তখনকার মুসলমান সমাজে খুবই আশার বাণী ছড়িয়েছিল। তার বেশকিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা দীর্ঘদিন শিশু-কিশোরদের মনে থাকবে। তার রচিত ‘আমাদের গ্রাম’, ‘বন্দি’, ‘কলমিলতা’ প্রভৃতি পদ্য, কবিতা আমাদের সবার মন জয় করে নেয়। তিনি ইতিহাস থেকে বিখ্যাত মনীষী, মহামানব, কবি-সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ প্রভৃতির জীবনতথ্য অবলম্বনে প্রচুর শিশুতোষ জীবনী লিখেছেন। জোর দিয়েই বলা যায় যে, এই সমস্ত জীবনীগ্রন্থ পাঠ করে শিশু-কিশোররা তাদের চরিত্র গঠন করতে এবং সেই আদর্শে পথ চলতে আগ্রহী হবে। বন্দে আলী মিয়ার অবদানের স্বীকৃতি ও সম্মান জানানোর জন্য ১৯৬২ সালে শিশুসাহিত্যে তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৬৫ সালে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে পুরস্কার ও সংবর্ধনা জানানো হয়। |